নতুন কারিকুলামে যোগ হচ্ছে আরও ৪ শ্রেণি

২০২৪ শিক্ষাবর্ষে নতুন কারিকুলামে যোগ হচ্ছে আরও চার শ্রেণি। ১ জানুয়ারি থেকে নতুন করে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে চালু হবে নতুন শিক্ষাক্রম। পর্যায়ক্রমে ২০২৫, ২০২৬ পর্যন্ত সব শ্রেণি নতুন কারিকুলামের আওতায় নিয়ে আসা হবে এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে বাস্তবায়ন হবে নতুন শিক্ষাক্রম। তবে নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীরা খাপ খাওয়াতে পারছে না বলে অভিযোগ অভিভাবকদের। তাদের দাবি, নতুন কারিকুলাম সম্পর্কে শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়েই পাঠদান শুরু করা হোক। নতুন কারিকুলামে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের যে বিকল্প নেই তা স্বীকার করেছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরাও। তারা বলছেন, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ চলমান। প্রাপ্ত তথ্যমতে, জাতীয় শিক্ষাক্রমে সবশেষ পরিবর্তন আনা হয় ২০১২ সালে। ওই পরিবর্তনে বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১৩ সাল থেকে। এর আগে বিভিন্ন সময় শিক্ষাক্রমে পরিমার্জন করা হলেও এবার শিক্ষায় রূপান্তর আনতে পাল্টে ফেলা হয় কারিকুলাম। যার শুরু হয় ২০২৩ সাল থেকে। প্রথম বছরে প্রথম শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পাঠদানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় নতুন শিক্ষাক্রমের। কিন্তু রূপান্তরিত এই শিক্ষাক্রমের আলোকে প্রণয়ন করা ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির দু’টি বই শিক্ষাবর্ষ শুরুর এক মাসের বেশি সময় পর আকস্মিকভাবে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এখন বছর শেষ হতে চললেও নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা চলছেই। অভিভাবকরা বলছেন, বদলে যাওয়া এ শিক্ষাব্যবস্থায় তাদের সন্তানেরা খাপ খাওয়াতে পারছেন না। শিক্ষা কারিকুলাম সংস্কারসহ ৭ দফা দাবি জানিয়ে গত জুন থেকে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষা আন্দোলন সম্মিলিত অভিভাবক ফোরাম। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় নানা কর্মসূচিও পালন করেন অভিভাবকরা। তাদের অভিযোগ, নতুন এ শিক্ষা ব্যবস্থা সন্তানদের শিক্ষার ভিত নস্ট করে দিচ্ছে। ফোরামের সদস্য নাসির উদ্দীন বলেন, যেখানে শিক্ষকেরা নিজেরাই নতুন কারিকুলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেননি, সেখানে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কি পাঠদান করাবেন? চলতি শিক্ষাবর্ষে তিন শ্রেণির জন্য চালু করা নতুন কারিক্যুলামের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। সেখানে আসছে শিক্ষাবর্ষে যদি আরও চার শ্রেণি নতুন কারিকুলামে পড়ানো হয় তাহলে শিক্ষার্থীরা কি শিখবে?’ শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়েই নতুন কারিকুলাম চালুর পরামর্শ দেন তিনি। এদিকে এই পরিস্থিতিতে বড় পরিবর্তন নিয়ে শুরু হতে যাচ্ছে নতুন শিক্ষাবর্ষ ২০২৪। দীর্ঘসময় ধরে চলা নবম শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজন উঠে যাচ্ছে ১ জানুয়ারি থেকে। এখন দশম শ্রেণি পর্যন্ত আগের মতো বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা নামে আলাদা বিভাগ থাকবে না। দশম শ্রেণি পর্যন্ত সবাইকে অভিন্ন ১০টি বিষয় পড়তে হবে। সব মিলিয়ে ২০২৪ সালে প্রাথমিকের দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণি শুরু হচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রমে শেখানোর ধরন বদলে গেছে, প্রথাগত পরীক্ষা উঠে গেছে ও যাচ্ছে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পুরোটাই মূল্যায়ন হবে সারা বছর ধরে চলা বিভিন্ন ধরনের শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে। চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঁচটি বিষয়ে কিছু অংশের মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন। বাকি অংশের মূল্যায়ন হবে সামষ্টিকভাবে, মানে পরীক্ষার ভিত্তিতে, তবে আগের মতো কোনো পরীক্ষা হবে না। অন্যদিকে এখন যেমন নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে এসএসসি পরীক্ষা হয়, নতুন শিক্ষাক্রমে শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে এসএসসি পরীক্ষা হবে। যেমন এখন একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে এইচএসসি পরীক্ষা হয়, নতুন শিক্ষাক্রমে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি বোর্ডের অধীনেই আলাদা পরীক্ষা হবে। তারপর এই দুই পরীক্ষার ফলাফল সমন্বয় করে এইচএসসির ফল প্রকাশ করা হবে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন বই পড়তে হবে। উচ্চ মাধ্যমিকে গিয়ে বিভাগ বিভাজন হবে। আবার পরীক্ষার ফল আগের মতো জিপিএর ভিত্তিতে হবে না। এ পদ্ধতি নিয়ে অভিভাবকদের বড় উদ্বেগ রয়েছে। তবে কুর্মিটোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আফসার আহমেদ বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা আনন্দের সঙ্গেই পাঠদানে অংশ নিচ্ছে। মুখস্ত পড়ার চেয়ে হাতেকলমে শেখার আগ্রহ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশি দেখা যাচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রম ঠিকমত বাস্তবায়ন করতে পারলে এটি আনন্দদায়ক হবে।’ এদিকে বিভিন্ন পর্যায় থেকে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে প্রস্তুতির ওপর বেশি জোর দেওয়ার পরামর্শ এসেছে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বাড়িয়ে তাদের নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়ে যোগ্য করে তোলা, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত কমানোর কথা বলছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অনেকেই। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার বলেন, ‘আমাদের প্রচুর সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে এবং এই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর এরইমধ্যে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ শুরু করেছে। এটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রতি বছর যেমন নতুন সাবজেক্ট যোগ হচ্ছে তেমনি শিক্ষকদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘শিক্ষকদের শূন্যপদ পূরণেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শূন্যপদ পূরণ ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন সহজ হবে। চলতি শিক্ষাবর্ষে নতুন কারিকুলামে যে কয়টি শ্রেণি চলছে সে বিষয়ে আমরা মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়েছি, শিক্ষার্থীরা এটা ভালভাবে মেনে নিয়েছে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক ট্রল হচ্ছে। আমরা সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখেছি, ওইসব প্রশিক্ষণ আমাদের শিক্ষকদের দেওয়া হয়নি। একটা চক্র অভিভাবকদের ও শিক্ষকদেরসহ বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষদের বিভ্রান্ত করতে এসব করছে। এ বিষয়ে মাউশি ও এনসিটিবি সজাগ রয়েছে। তারা বিভ্রান্তি দূর করতে উদ্যোগ নিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নতুন কারিকুলামে পাঠদানে শিক্ষকদের অবশ্যই প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে এবং প্রশিক্ষণ ছাড়া পাঠদান সম্ভব নয়।’ নতুন কারিকুলামে ২০২৫ সালে যোগ হচ্ছে প্রাথমিকে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি। আর মাধ্যমিকে দশম শ্রেণি নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় আসবে। আর উচ্চ মাধ্যমিকের একাদশ ২০২৬ সালে এবং দ্বাদশ শ্রেণি ২০২৭ সালে নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় আসবে। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার গতানুগতিক ধারা বদলে যাবে। শিখন ফলকেন্দ্রিক শিক্ষাক্রম থেকে বের হয়ে যোগ্যতাভিত্তিক শিখনকে গুরুত্ব দিয়ে পরিবর্তন করা হয়েছে এ শিক্ষাক্রম।